কেন মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮, ছেলেদের ২১?
বাংলাদেশে বিয়ের ক্ষেত্রে কনের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ ও পাত্রের বয়স ২১ ঠিক রেখে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা নিয়ে বা বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রপাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে এই আইনে। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। পাশাপাশি বাল্য বিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ দুই বছর ও সর্বনিম্ন দুই মাস এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ও সর্বনিম্ন দশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
এটাতে কি বাল্য বিয়ে ঠেকানো সম্ভব? ১৬ বছরে বিয়ে আর নির্যাতিত হওয়া একই কথা। ১৮ বছর বয়সের আগে কারও কারও বিয়ে হলে আর যা হোক, সে বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন হবে না। যেখানে ১৮ বছর না হলে কেউ ভোটাধিকার পাচ্ছে না। যেখানে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, দেশের শিশু আইনসহ সব জায়গাতেই শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত। এতএব, ১৬ বছর বয়স মানেই নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি, সেটা শিশু বয়স। তাহলে ১৬ বছর বয়সে একটি মেয়ের যখন বিয়ে হবে, স্বভাবতই যে কোনো সময় সে মা হতে পারে এবং সেটা ১৮ বছরের আগেই। ১৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে সে নিজেই শিশু, সে কীভাবে আরেকটা শিশুর জন্ম দিতে পারে? কীভাবে সে মাতৃত্বের মতো একটি গুরুদায়িত্ব তার ছোট্ট শরীরে বহন করতে পারে? আর বাবা-মাকেই বা কেন
আমরা এমন অমানবিক কাজটি করতে আইন তৈরি করে উৎসাহিত করব?
বিয়ের বয়স আইন অনুযায়ী ১৬ নাকি ১৮, তা হতে হবে নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। একই বিষয়ে একই সঙ্গে দুটি বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে কীভাবে। এতে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ বাবা-মা যত শিগগির পারেন মেয়েকে পাত্রস্থ করতে চান। কিন্তু ১৬ বছর বয়স বিয়ের জন্য কোনোভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। ন্যূনতম ১৮ বছর থাকতে পারে।
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছরের পাশাপাশি ১৬ করার সরকারি প্রস্তাব এবং এর পক্ষে দেখানো যুক্তি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হলো এ সিদ্ধান্ত মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনা ধারণ করার মতো।
প্রতিদিন দেশে যৌতুকের দাবিতে অসংখ্য নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। এ দেশে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদেরই নিজের পায়ে দাঁড়াতে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। ১৬ বছরের একটি মেয়ে যদি বিয়ের পর নির্যাতনের শিকার হয়, যদি অল্প বয়সেই তার স্বামী মারা যায় বা সম্পর্কোছেদ হয় তাহলে তার পুরো জীবন একটা ভয়াবহ অনিশ্চয়তার চাদরে ঢেকে যাবে।
সমগ্র বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করার পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে, রয়েছে অসংখ্য গবেষণা। এটাকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তারা আসলে সারা বিশ্বের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছেন। বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন।
এ রকম একটি সময়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর পক্ষে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তাতে আধুনিক যুগেও সন্তান উৎপাদন ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনকেই নারীর একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ আইনটি টিকে গেলে এই অল্পসংখ্যক মধ্যযুগীয় মানসিকতার মানুষেরা আরও কথা বলবেন, আরও খোঁড়া যুক্তি স্থাপন করার সুযোগ পাবেন। নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে উস্কানি দেবেন। নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় যার প্রভাব হবে মারাত্মক নেতিবাচক।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৮ বছরের নিচে কন্যাসন্তানের বেশি বিয়ে হয়, এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ৬৪% শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের।
বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের নারী তথা জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। তাই রাজনৈতিক স্বার্থ অদায়ের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রিক স্বার্থের জায়গা থেকে অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থে ১৬ বছরের বিশেষ বিধান না রেখে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর বহাল রেখে দ্রুত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাশের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম।
কন্যা শিশুর বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স শর্তহীনভাবে ১৮ বছর বহাল রাখার দাবি জানিয়ে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক গোলটেবিল বৈঠকে এ দাবি জানায় সংগঠনটি। এ সময় বক্তারা মেয়েদের বিয়ের বয়স শর্তসাপেক্ষে (বিশেষ বিধান) ন্যূনতম ১৬ বছর রেখে নতুন আইন পাস না করে শর্তহীনভাবে ১৮ বছর বহাল রাখার দাবি জানান।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনুর সঞ্চালনায় বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি। বিগত দশকগুলোতে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি ও সুপেয় পানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসামান্য অগ্রগতি সাধন করেছে ঠিকই কিন্তু বাল্যবিয়ের ভয়াবহতা বিবেচনায় বাংলাদেশে অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী, দারিদ্র্যতা, অভিভবাকদের অসচেতনতা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ কন্যাশিশুকে ১৮ বছর এবং ৩২ শতাংশ কন্যাশিশুকেই ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স শর্তসাপেক্ষে (বিশেষ বিধান) ১৬ বছর রেখে শিগগিরই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করতে চাচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি, আইনটি পাস হলে তা হবে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধক। এর ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন ও জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, আজ থেকে প্রায় ১শ’ বছর আগে নারীর বিয়ের বয়স ন্যূনতম ২১ বছর করার জন্য বেগম রোকেয়া আন্দোলন করেছিলেন। অথচ একবিংশ শতকে এসে তার অগ্রগামিতা না হয়ে সরকারের মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ বছর করার পাঁয়তারাকে পশ্চাৎগামী মানসিকতা বলে মনে করা হচ্ছে। এটা বাস্তবায়নে দেশ বা সমাজের জন্য হবে মারাত্মক ক্ষতি এবং সরকারের এটা হাস্যকর পদক্ষেপ বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, বাল্য বিবাহ বন্ধে আরো অনেক বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান মিডিয়াগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রত্যেক জেলা শহরে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। বাল্য বিবাহের শিকার কন্যাশিশুরা মানসম্মত শিক্ষা, পুষ্টি ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তারা অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশু।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সমাজের সকল পেশাজীবী মানুষকে সচেতন হয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয় হবে যদি নারীদের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে। আমরা ভাবছি দেশে নারীদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নতি হয়েছে আসলে তা না হয়ে দেশে বখাটেপনা, মাদকাসক্তদের পরিমাণ বেড়েছে, যার মাধ্যমে জাতীর চরম অনিষ্ট ডেকে আনছি। তাই আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
উল্লেখ্য, শিশু বিবাহের অভিশাপ থেকে কন্যাশিশুদেরকে মুক্ত করতে যে যার অবস্থান থেকে পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির দাবিতেই এই গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। যার কর্মসূচিগুলো পর্যায়ক্রমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্তরে মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করবে।